মো. আজিজুল হক
14/05/2013
জন্মের পর ওদের মায়ের পেটেই ভাত ছিলোনা
তাই জননীর বুকে দুধও ছিলো কম।
আমরা যেমন শখ করে মাঝে মাঝে আঙুল চুষি
কিন্তু আঙুল দিয়ে কিছু বেড় হয় না,
ওড়া ও তেমনি মায়ের স্তনের বোঁটা মুখে দিয়ে
কাটিয়েছে হাজারো রাত, কিচ্ছু বেড় হয়নি।
পেটের দায়ে শহরে এসে বড় বড় বিলবোর্ড দেখেছে
সেখানেই হরলিক্স, ডানোর সাথে ওদের পরিচয়,
ছয়মাস বয়স থেকেই ওরা পানতা ভাত খায়
আর পাঁচ বছর বয়সে বাবার সাথে মাঠে যেয়ে পোলাও বিরানির চাল ফলায়।
সেই পোলাও আর বিরানি আমরা খাই
প্রতিটি ভাতের গায়ে ওদের ছবি আঁকা আছে,
কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে না
কারণ আমরা তো অন্ধ।
পনের বছর বয়সে শহরে আসে
পনেরশ টাকা বেতনের চাকরি।
কী চাকরি করে জানো তো?
তোমার শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখ,
তোমার জামায় তাদের ছবি আঁকা আছে,
কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে না কারণ আমরা তো অন্ধ।
বিরাট শক্তিধর সূর্য কোনদিনই ওদের সাথে পারে না
ওরা প্রতিদিন তার আগে জেগে যায়।
বাজারের সবচেয়ে বড় চাউলের ভাত
আর একটা ডিম ভেজে তিনজনে খায়।
নিজেকে নিজেরা শান্তনা দেয়,
“ডিম খাওয়া আর আস্ত মুরগী খাওয়া তো সমান কথা”।
তারপর ওরা চাকরিতে যায়
ওদের অফিসটা কেমন জানো তো?
সরিষার তেল ভাঙানো ঘানির মত
সেখানে ওদেরকে ঢুকিয়ে চিপে-পিষে টাকা বেড় করা হয়।
সেই টাকায় কুয়েতি ‘সিগার’ আর ‘প্রাডো’ কেনা হয়।
বার ঘন্টা কাজ করে ওড়া ক্লান্ত হয় না, হয় মৃত প্রায়।
পরের দিন আবার আস্ত মুরগি খেয়ে শুরু হয়।
একদিন সেই ঘানির নিচে ওরা চাপা পরে
হাজারে হাজারে মরে
একজন আবার বেঁচে ফেরে
সতের দিন পরে!
ওরা বেঁচে থাকলেও আমাদের লাভ, মরলেও।
ওরা বেঁচে থাকলে ওদের দিয়ে মিছিল করানো যায়,
ওদের রক্ত নিংরানো টাকায় আয়েশ করা যায়,
ওদের অধিকার আদায়ের কথা বলে নিজেকে বিশেষভাবে খ্যাত করা যায়,
ওদের দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যায়,
ভোটের সময় ওদের ভোট পাওয়া যায়,
মালিকের কুলাঙ্গার ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য ওদের একজনকে ফাঁসিয়ে দেয়া যায়,
ওদেরকে দিয়ে সবকিছু করা যায়,
আবার মন চাইলে ওদের মধ্যকার সুন্দরী মেয়েটাকে ..................।
ওরা মরলেও আমাদের লাভ।
ওরা মরলে সাংবাদিকদের আর খবরের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না,
আমাদের আর রিমোর্ট হাতে ঘন ঘন চ্যানেল পাল্টাতে হয় না,
রাজনীতিবিদদেরও বক্তৃতার জন্য নতুন বিষয় খুঁজতে হয় না,
সাহায্য তহবিলে কিছু টাকা দিয়ে পত্রিকায় নিজের নাম লেখানো যায়,
ওদের একজনকে নিজের আত্মীয় দাবি করে কিছু কামিয়ে নেয়া যায়,
দেশে শোক দিবস ঘোষণা করে বিশ্বের দরবারে আমাদের শোক তুলে ধরা যায়,
ওরা মরলে আমাদের আরো কত লাভ।
এবারের ধ্বসের হিসাবটা কষে ফেলি
যেহেতু ওরা মায়ের পেট থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত চাপের মধ্যে থাকে
সেহেতু উচ্চতায় গড়ে পাঁচ ফুটের বেশি হবেনা।
প্রায় একহাজার পঞ্চাশটা মৃত দেহ
গড়ে পাঁচ ফুট হলে প্রায় পাঁচ হাজার দুইশত পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ।
ইস! আর কয়েকটা মরলেই ওদের লাশ দিয়ে পদ্মা সেতুটা হয়ে যেত।
আচ্ছা ওরা এত মরে কেন?
আমার এক বন্ধু বলেছে, “ওরা মরে কারণ ওরা মানুষ নয়, ওরা গরীব”
রাষ্ট্র কৃতিত্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছে যে উদ্ধার কাজ শেষ
আর ওদের এক লাশের আত্মা মুচকি হেসে বলে গেল,
“আমরা যে দারিদ্র নামক এক বিশাল ধ্বসে পড়া ইমারতের নিচে হাজার বছর ধর চাপা পড়ে আছি
সেখানকার একটা ইটও আজ পর্যন্ত সরানো হয় নি
গরীব নামক একটি প্রাণীও আজ পর্যন্ত জীবিত বা মৃত উদ্ধার হয়নি
কারণ উদ্ধার কাজ এখনও শুরু-ই হয়নি”